এস আলমের পিএস থেকে ডিএমডি হওয়া আকিজ উদ্দিন: ব্যাংকিং খাতে অস্বাভাবিক লেনদেন ও বেনামি হিসাব
নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের একটি অন্ধকার অধ্যায়ের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) আকিজ উদ্দিনের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবগুলোতে এ পর্যন্ত স্থিতি রয়েছে প্রায় এক হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, এর বাইরে সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা পরিচালিত হয়েছে। একটি আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার বিস্তারিত তদন্ত প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
তদন্তকারীরা বলছেন, স্বৈরাচারী সরকারের শেষ সময়ে আকিজ উদ্দিন ব্যাংকিং খাতে ছিল এক আতঙ্কের নাম। তিনি ছিলেন শীর্ষ ব্যাংক লুটেরা এস আলমের ব্যক্তিগত সচিব (পিএস)। অভিযোগ ওঠেছে, এই সময়ে তিনি কৌশলে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নিজের প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
সূত্র জানায়, পতিত সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশে পলাতক বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বেসরকারি খাতের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি পদে আকিজ উদ্দিনকে বসানোর ব্যবস্থা করেন। তথ্য বলছে, আকিজ উদ্দিন একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিয়োগপত্র গ্রহণ করেন গভর্নরের হাত থেকে। পরবর্তীতে তিনি আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গভর্নরের বাসায় নিয়মিত আড্ডা চলত আকিজ উদ্দিনের সঙ্গে। ব্যাংক এবং ব্যবসায়িক লেনদেনে এই ঘনিষ্ঠতা তার জন্য সুযোগের দরজা খুলে দিয়েছিল। সূত্র জানায়, এস আলমের দখলকৃত ৮টি ব্যাংক থেকে নানা উপায়ে অর্থ সরবরাহ করা হতো সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের জন্য। একই সঙ্গে অভিযোগ উঠেছে যে, আকিজ উদ্দিন নিজেও এই লেনদেন থেকে অবৈধভাবে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলেন।
অনুসন্ধানের সূত্রপাত, সূচনা হয় সোনালী ব্যাংকের চট্টগ্রাম পাঁচলাইশ শাখার গ্রাহক ‘আলম ট্রেডিং এন্ড বিজনেস হাউস’ নামক প্রতিষ্ঠানের অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়ার মাধ্যমে। সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটি মূলত রড, সিমেন্ট এবং সিআই শীট বিক্রেতা হিসেবে নিবন্ধিত।
তদন্তকারীরা বলছেন, হিসাব খোলার ফরম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি আকিজ উদ্দিনের পরিচিতির ভিত্তিতে খোলা হয়েছিল। জরুরি প্রয়োজনে গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আকিজ উদ্দিনের ফোন নম্বর ০১৯৮৫৫০৮০০০ ব্যবহার করা হতো। তথ্য বলছে, এই হিসাবের মাধ্যমে আকিজ উদ্দিন তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন লেনদেন পরিচালনা করতেন।
সূত্র জানায়, এরপর আকিজ উদ্দিনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে বেশ কিছু হিসাব পরিচালিত হওয়ার নজির পাওয়া যায়। এসব হিসাব ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বিনিয়োগ গ্রহণ, করপোরেট সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) অর্থ আত্মসাৎ এবং অন্যান্য উপায়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা বের করা হতো।
তদন্তে দেখা গেছে, আকিজ উদ্দিনের নিজ নামে মোট ১৩টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। তার স্ত্রী রোকসানা খানমের নামে তিনটি, মা রাবিয়া খাতুনের নামে ছয়টি, বোন হোসনে আরা বেগমের স্বামী নজরুল ইসলামের নামে ৪৬টি, বোন শারমিন আকতারের স্বামী নাছির উদ্দীনের নামে ২৮টি, ভাই মুহাম্মদ সাইফু উদ্দীনের নামে ৯০টি, এবং তার পিএস সাদ্দাম হোসেন ও স্ত্রী মর্জিনা আক্তারের নামে ৪৩টি হিসাব চালু ছিল।
তদন্তে দেখা গেছে, এসব হিসাবের জরুরি যোগাযোগের জন্য আকিজ উদ্দিনের ব্যক্তিগত ফোন নম্বর ব্যবহার করা হতো। সূত্র জানায়, এই ব্যাংক হিসাবগুলোতে ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, স্যোসাল ইসলামী ব্যাংক সহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে এস আলম এবং সরকারের শীর্ষ মহলে সরবরাহ করা হতো।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আকিজ উদ্দিনের বেনামি হিসাবগুলোর মধ্যে কিছু হিসাবের স্থিতি নিম্নরূপ, নুরুল আলম, মুহাম্মদ মুশতাক মিঞা, নজরুল ইসলাম ও জিয়াউর রহমান সংশ্লিষ্ট হিসাব: ৩৮৬ কোটি ২ লাখ টাকা। আকিজ উদ্দিন ও রোকসানা খানম: ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। পিএস সাদ্দাম হোসেন ও মর্জিনা বেগম: ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আলমাস আলী ও বেদারুল ইসলাম: ৮০০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। সাইফু উদ্দিন, গোলামুর রহমান ও রাবেয়া খাতুন সংশ্লিষ্ট হিসাব: ৭৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
সূত্র জানায়, এসব হিসাব ব্যবহার করে আকিজ উদ্দিন স্বার্থসংশ্লিষ্ট লেনদেনগুলো পরিচালনা করতেন। আলম ট্রেডিং এন্ড বিজনেস হাউস’ নামক প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামে নিবন্ধিত।
সূত্র বলছে, প্রতিষ্ঠানটির মালিক নুরুল আলম হলেও, আকিজ উদ্দিনের ফোন নম্বর ব্যবহার করা হতো হিসাবের জন্য। তদন্তকারীরা এটিকে আকিজ উদ্দিনের বেনামি প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নিবন্ধিত ‘নজরুল এন্টারপ্রাইজ’ নামক প্রতিষ্ঠানের মালিক মো: নজরুল ইসলাম, যিনি আকিজ উদ্দিনের বোন হোসনে আরা বেগমের স্বামী।
সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা ঢাকা হলেও হিসাবগুলো চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যাংকে খোলা হয়। পরিচিতি যাচাই করে দেখা গেছে, ফোন নম্বর ০১৮৩৫২৬৬১৫৫ আকিজ উদ্দিনের। ফলে, এটি আরেকটি বেনামি প্রতিষ্ঠান বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্তকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন, কীভাবে এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত পরিচয় ব্যবহার করে এত বড় পরিমাণ অর্থ পরিচালনা করা সম্ভব হলো। তথ্য বলছে, আকিজ উদ্দিন ও তার সহযোগীরা ব্যাংকের নিয়মনীতি এড়িয়ে অস্বাভাবিক লেনদেন পরিচালনা করেছেন।
সূত্র জানায়, এসব লেনদেনের মাধ্যমে শুধুমাত্র এস আলম এবং সরকারের শীর্ষ মহল নয়, আকিজ উদ্দিন নিজেও অর্থ লাভ করেছেন। আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এরকম লেনদেনের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে “অস্বাভাবিক পরিস্থিতি” সৃষ্টি হয়েছিল।
একজন ব্যাংক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে, "আমরা নিয়ম অনুযায়ী কাজ করতে চেয়েছি, কিন্তু যেহেতু আকিজ উদ্দিন শীর্ষ পদে ছিলেন এবং গভর্নরের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন, তাই কেউ তার বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারেনি।"
অন্য একজন তথ্যসূত্র জানায়, “আকিজ উদ্দিনের ফোন নম্বর ব্যবহার করে বেনামি লেনদেন চালানো হতো। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যা সাধারণ ব্যাংক কর্মকর্তা পর্যায়ে বোঝা সম্ভব নয়।
তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, আকিজ উদ্দিনের ব্যাংক হিসাব, বেনামি প্রতিষ্ঠান এবং পরিবার সংক্রান্ত হিসাবগুলোতে কমপক্ষে এক হাজার ২৬৬ কোটি টাকা স্থিতি রয়েছে। এ ছাড়াও সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা পরিচালিত হয়েছে।
সূত্র জানায়, আকিজ উদ্দিনের এসব কর্মকাণ্ড ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
তদন্তকারীরা বলছেন, এ ধরনের লেনদেন এবং বেনামি হিসাব চালানোর ঘটনা প্রমাণ করে, কীভাবে রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি সম্ভব। এটি শুধু একটি ব্যক্তির না, পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
প্রশ্ন উঠছে, কেন সরকারের শীর্ষ মহল এবং ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক সংস্থা যথাযথ পদক্ষেপ নিল না। তথ্য বলছে, এই বিষয়টি এখনও অনুসন্ধানের বাইরে নয়।
সূত্র জানায়, আকিজ উদ্দিনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু মোবাইল নম্বরে রিং করলেও কেউ রিসিভ করেননি।
তদন্ত প্রতিবেদনে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, এমন অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়ে সরকারি তদারকি জোরদার করা, আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কার্যকরী পদক্ষেপ নিশ্চিত করা জরুরি।