নাজমুল আদনান, টাঙ্গাইল
বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোটি কোটি ব্যবহারকারী নিয়মিত এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে সক্রিয় থাকেন। কিন্তু তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো জুয়া ও অনলাইন বেটিং সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনের জন্য এক ভয়াবহ প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী জুয়া নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, বিভিন্ন কৌশলে এই বিজ্ঞাপনগুলো ছড়িয়ে পড়ছে, যা বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করছে এবং সমাজে গভীর সামাজিক অবক্ষয় তৈরি করছে।
সূত্র জানায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জুয়াড়ি চক্রগুলো অত্যন্ত সুচিন্তিত এবং আগ্রাসী কৌশল অবলম্বন করছে।
টার্গেট গ্রুপ: বিজ্ঞাপনের মূল লক্ষ্য তরুণ প্রজন্ম ও শিক্ষার্থীরা। কৌতূহল এবং দ্রুত অর্থ উপার্জনের লোভে তারা সহজেই এসব সাইটে আসক্ত হচ্ছে।
তারকাদের ব্যবহার ও প্রতারণা: কিছু জুয়ার সাইট ক্রিকেটার বা জনপ্রিয় তারকাদের ছবি, ভিডিও এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে ভুয়া কনটেন্ট তৈরি করে নিজেদের বৈধ ও আকর্ষণীয় দেখানোর চেষ্টা করছে।
প্রলোভনমূলক অফার: বিজ্ঞাপনে লোভনীয় আর্থিক পুরস্কার, সাইন-আপ বোনাস এবং ডিপোজিট ম্যাচের মতো অফার দেখিয়ে ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করা হয়।
সহজ লেনদেন: মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে জুয়ার সাইটে টাকা বিনিয়োগ ও উত্তোলন সহজ হওয়ায় আসক্তি দ্রুত বাড়ছে।
অবৈধ বিজ্ঞাপন: ফ্যাক্টচেকিং সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে হাজার হাজার জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে, যা মেটার নীতিমালা লঙ্ঘন করে।
তথ্য বলছে, জুয়ার আসক্তি ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।
আর্থিক ক্ষতি ও ঋণগ্রস্ততা: জুয়ায় আসক্তরা প্রথমে বাড়তি আয়ের জন্য নামলেও চূড়ান্তভাবে বিপুল অর্থ ক্ষতিতে জর্জরিত হচ্ছে।
পারিবারিক ভাঙ্গন: পরিবারের কোনো সদস্য জুয়ার নেশায় ডুবে গেলে পুরো পরিবারে হতাশা, কলহ এবং সম্পর্কের অবনতি দেখা দেয়।
নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়: সহজ পথে অর্থ উপার্জনের মানসিকতা তরুণদের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল করছে।
অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি: দেনা পরিশোধ বা আরও অর্থ উপার্জনের জন্য জুয়ায় আসক্তরা চুরি, ছিনতাই বা প্রতারণার সঙ্গে জড়িত হতে পারে।
বাংলাদেশে জুয়া প্রতিরোধে ১৫৭ বছরের পুরনো আইন ব্যবহার হচ্ছে। যদিও ‘জুয়া প্রতিরোধ আইন, ২০২৩’ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা এখনো খসড়া পর্যায়ে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সমস্যার সমাধানে জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
আইনের কঠোর প্রয়োগ: সকল ধরনের জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারের ওপর অবিলম্বে নিষেধাজ্ঞা জারি করা এবং আইন ভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
যুগোপযোগী আইন: একটি আধুনিক ও কার্যকর জুয়া প্রতিরোধ আইন দ্রুত প্রণয়ন ও কার্যকর করা।
নিয়মিত নজরদারি: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নিয়মিত নজরদারি বাড়াতে হবে এবং অবৈধ জুয়াড়ি চক্রের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সচেতনতা বৃদ্ধি: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে জুয়ার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
প্ল্যাটফর্মের দায়বদ্ধতা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে তাদের নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করে অবৈধ জুয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে হবে।
প্রশ্ন উঠছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জুয়ার এই বিস্তার রোধ করা না গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কতটা বিপন্ন হতে পারে? তথ্য বলছে, এটি শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং সমাজের জন্য একটি নীরব ঘাতক। সরকারের, পরিবার ও প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মের সম্মিলিত উদ্যোগ ও সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।