যমজ সন্তান প্রসবের সময় তরুণীর মৃত্যু, প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
ঝিকরগাছা (যশোর) প্রতিনিধি
যশোরের ঝিকরগাছায় ভুয়া ডাক্তার ও অবৈধ ক্লিনিকের দৌরাত্ম্য আবারও আলোচনায়। সোহানা (১৯) নামের এক তরুণীর মৃত্যু যেন সেই বাস্তবতার নির্মম প্রমাণ। অভিযোগ উঠছে, প্রশাসনের নীরবতা এবং অর্ধেক-অসফল পদক্ষেপের কারণেই ‘কসাই ডাক্তার’ নামে কুখ্যাত শরিফের মতো হাতুড়ে চিকিৎসকেরা এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর ঝিকরগাছার শিওরদাহ গ্রামের দিনমজুর ইয়ানুরের মেয়ে সোহানা প্রসববেদনায় পড়ে স্থানীয় ফেমাস ক্লিনিক-এ ভর্তি হন। পরিবারের স্বল্প আয়ের কারণে বড় হাসপাতাল নয়, গ্রামের এই ক্লিনিকেই ভরসা করেছিলেন তারা।
প্রথমে ক্লিনিক মালিক আজগর আলী আশ্বস্ত করেন—যশোর থেকে একজন “বড় ডাক্তার” আনা হবে সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য। কিন্তু তথ্য বলছে, তিনি পরিবর্তে পাশে অবস্থিত সালেহা ক্লিনিকের মালিক শরিফকে ডাকেন, যিনি আসলে নন-মেট্রিক শিক্ষিত, স্বঘোষিত ডাক্তার।
অভিযোগ উঠছে, শরিফ সিজার অপারেশনের সময় মারাত্মক চিকিৎসাগত ভুল করেন। সোহানার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে যশোর সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু রাস্তাতেই মৃত্যু ঘটে তার। যমজ সন্তানও বাঁচানো যায়নি।
সোহানার বাবা ইয়ানুর সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের কাছে আগেই বলা হয়েছিল, বড় ডাক্তার আসবেন। আমরা গরিব মানুষ, সব বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু পরে জানতে পারি, আসলে কোনো ডাক্তারই ছিল না। মেয়েকে নিয়ে খেলেছে ওই ভুয়া লোকেরা।”
সোহানার মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে অভিযোগ করেন, “আমাদের মেয়ে এখন মাটির নিচে। কিন্তু যারা মেরেছে, তারা এখনো ক্লিনিক চালাচ্ছে। এটা কেমন বিচার?
ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকেই।
এরপর ১৮ সেপ্টেম্বর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাভিদ সারোয়ারের নেতৃত্বে একটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। তবে প্রশ্ন উঠছে—সেই অভিযানে কেবল তালাবদ্ধ ফেমাস ক্লিনিকে আরেকটি তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। অথচ সোহানার মৃত্যুর সঙ্গে সরাসরি জড়িত সালেহা ক্লিনিক এবং শরিফের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, “মাত্র ১০০ ফুট দূরে সালেহা ক্লিনিক চালু থাকলেও সেখানে অভিযান হয়নি। তাহলে কি প্রভাবশালী কারও ছত্রচ্ছায়ায় চলছে এই অবৈধ ব্যবসা?”
স্থানীয় প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, শরিফ ও আজগর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এতদিন ধরে ক্লিনিক চালিয়ে আসছেন। অভিযোগ রয়েছে, তারা প্রভাবশালী স্থানীয় একটি মহলের ঘনিষ্ঠ। ফলে বহুবার অভিযোগ উঠলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) যশোর শাখার একজন সিনিয়র চিকিৎসক বলেন, “সিজারিয়ান অপারেশন করতে হলে সার্জারি, অ্যানেস্থেসিয়া ও গাইনোকলজির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার দরকার। কিন্তু এখানে এমন একজন ব্যক্তি অপারেশন করেছেন, যিনি নন-মেট্রিক। এটি একধরনের হত্যাকাণ্ড।”
তথ্য বলছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১২ হাজার মা চিকিৎসাগত অবহেলার কারণে জীবন হারান। এর বড় অংশই ঘটে অবৈধ ক্লিনিক ও ভুয়া ডাক্তারদের কারণে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী—
দেশের গ্রামে ও ছোট শহরে নিবন্ধনবিহীন ক্লিনিকের সংখ্যা প্রায় ৮,০০০।
ভুয়া বা হাতুড়ে ডাক্তারদের হাতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে গত এক দশকে প্রায় ১ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়েছেন।
চিকিৎসা অবহেলায় মাতৃমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি যশোর, কুমিল্লা ও বরিশাল অঞ্চলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অব্যবস্থাপনা বন্ধে আইন থাকলেও প্রয়োগ দুর্বল।
ঘটনার পর স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সচেতন নাগরিক সমাজ রোববারের মধ্যে দুটি ক্লিনিক স্থায়ীভাবে বন্ধ করার দাবি তুলেছেন। তারা বলছেন, “লাইসেন্স বাতিল না করলে এবং শরিফ-আজগরকে গ্রেপ্তার না করলে আমরা রাজপথে কঠোর আন্দোলনে নামব।
সামাজিক গবেষকরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা শুধু একটি পরিবারের ক্ষতি নয়, পুরো সমাজে অবিশ্বাস তৈরি করে। মানুষ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারায়। এছাড়া, দরিদ্র পরিবারগুলো আর্থিকভাবে বিধ্বস্ত হয়।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ভুক্তভোগী পরিবারগুলো দীর্ঘমেয়াদে মানসিক আঘাত ও ট্রমার শিকার হন।
কেন ভুয়া ডাক্তার ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হলো না?
প্রশাসন কি ইচ্ছাকৃতভাবে সালেহা ক্লিনিককে এড়িয়ে গেছে?
বারবার অভিযোগের পরও ভুয়া ডাক্তারদের লাইসেন্স বাতিল হচ্ছে না কেন?
রাজনৈতিক প্রভাব কি এ ধরনের অপরাধীদের রক্ষা করছে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
ভুয়া ডাক্তার শনাক্ত করে দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে। নিবন্ধনবিহীন ক্লিনিক স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকি জোরদার করতে হবে।স্থানীয় জনগণকে সচেতন করতে হবে—অবৈধ ক্লিনিকে চিকিৎসা না নিতে।
সোহানার মৃত্যু এক পরিবারের সীমাহীন বেদনা হলেও এটি আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভয়াবহ চিত্রও তুলে ধরেছে। প্রশাসনের নীরবতা, ভুয়া ডাক্তারদের দৌরাত্ম্য আর রাজনৈতিক প্রভাব মিলিয়ে একটি অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন একটাই—আর কত সোহানাকে প্রাণ হারাতে হবে, তার পর আমরা জেগে উঠব?