খুলনা সিটি করপোরেশনে ৬০০ কোটি টাকার টেন্ডার বিতর্ক
খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) উন্নয়ন কার্যক্রম ঘিরে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার টেন্ডার বণ্টনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। অভিযোগ উঠেছে, মেয়রের মেয়াদকালে নির্দিষ্ট কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে একচেটিয়াভাবে কাজ দিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ লোপাট হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) খুলনা কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে ঘনিষ্ঠ মহলের প্রভাব খাটিয়ে কাজ বণ্টন করা হয়। এ সময় প্রকল্প মূল্যায়ন, যোগ্যতা যাচাই এবং কার্যসম্পাদন পর্যবেক্ষণের মতো মৌলিক নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে মানা হয়নি।
প্রশ্ন উঠছে—কারা পেলো এই কাজ?
তথ্য বলছে, ১০টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মেয়রের ঘনিষ্ঠমহলই অধিকাংশ কাজ পেয়েছিল। এর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠানের নাম ইতোমধ্যেই তদন্তে উঠে এসেছে—
হোসেইন ট্রেডার্স (মালিক সেলিম হুজুর): প্রায় ৫২ কোটি টাকা
তাজুল ট্রেডার্স (মালিক যুবলীগ নেতা তাজুল ইসলাম): প্রায় ৪০ কোটি টাকা
মেসার্স আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্স (মালিক আওয়ামী লীগ নেতা আজাদ): প্রায় ৪৫ কোটি টাকা
রোজা এন্টারপ্রাইজ: প্রায় ৩৬ কোটি টাকা
সূত্র জানায়, এককভাবে এসব প্রতিষ্ঠান প্রায় ৬০০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে, যা এখন তদন্তাধীন।
‘নাম-বেনামে নিয়ন্ত্রণ’ অভিযোগ
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে সাবেক মেয়র নাম-বেনামে ঠিকাদারি লাইসেন্স ব্যবহার করে প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন। কাজ বণ্টনের প্রতিটি ধাপে কমিশন আদায়ের অভিযোগও উঠেছে।
দুদকের একটি সূত্র বলছে, পরিকল্পনা বিভাগের এক কর্মকর্তা এখানে মূল সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছেন। দরপত্র প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে অর্থ লেনদেন এবং কমিশন নির্ধারণ—সবকিছুই মূলত তার মাধ্যমে সম্পন্ন হতো।
তালুকদার আব্দুল খালেক কোথায়?
৫ আগস্টের পর থেকে সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক প্রকাশ্যে আর দেখা দেননি। স্থানীয়ভাবে প্রশ্ন উঠছে—তিনি আত্মগোপনে আছেন নাকি রাজনৈতিক আশ্রয় নিচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, তার বিরুদ্ধে খুলনা মহানগরসহ জেলার বিভিন্ন থানায় এক ডজনেরও বেশি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে হত্যা মামলাও রয়েছে। পাশাপাশি চলতি বছরের ৯ জুলাই দুদক তার বিরুদ্ধে ১৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা দায়ের করে। তার স্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুন নাহার এর বিরুদ্ধেও ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা হয়েছে।
তদন্ত কোন দিকে যাচ্ছে?
দুদক কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, কাজ বণ্টনের পদ্ধতি, প্রকল্প বাস্তবায়নের মান, অর্থ লেনদেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভূমিকা যাচাই করে দ্রুত চার্জশিট প্রস্তুতের কাজ শুরু হবে।
তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এই তদন্ত কেবল ব্যক্তি নয়, বরং পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসছে। উন্নয়ন কাজ যদি নিয়ম ভেঙে হয়, তাহলে তার দায় কে নেবে?”
অভিযোগ প্রমাণিত হলে এটি শুধু আর্থিক নয়, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির একটি বড় উদাহরণ হয়ে দাঁড়াবে। তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, সবকিছুই আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে যাচাই হোক—তাহলেই প্রকৃত চিত্র পরিষ্কার হবে।