বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সাবেক পেসার জাহানারা আলমের বিস্ফোরক অভিযোগে নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নারী দলের কয়েকজন খেলোয়াড়, কর্মকর্তা ও সাবেক নির্বাচকের বিরুদ্ধে অনৈতিক আচরণ ও হয়রানির অভিযোগ তুলে দেশের ক্রিকেটে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।

অস্ট্রেলিয়ায় ক্লাব ক্রিকেট খেলতে থাকা জাহানারা অভিযোগ করেন, নারী দলের দায়িত্বে থাকা কয়েকজনের আচরণ ছিল অপেশাদার, অসম্মানজনক ও মানসিকভাবে কষ্টদায়ক।” তার দাবি, বিষয়গুলো তিনি বারবার বিসিবিকে জানালেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

“দেড় বছরে অসংখ্যবার অভিযোগ করেছি। তৎকালীন নারী উইংয়ের প্রধান নাদেল স্যারকে জানিয়েছিলাম। সাময়িক পরিবর্তন এলেও পরে সব আগের মতোই হয়ে যেত,” বলেন তিনি এক সাক্ষাৎকারে।

সবচেয়ে আলোচিত অভিযোগ এসেছে সাবেক নির্বাচক মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জুর বিরুদ্ধে। জাহানারার ভাষায়, “উনি একদিন এসে আমার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করেন, পিরিয়ড চলছে কতদিন? শেষ হলে জানাতে বলেন, যেন দেখা করতে পারি।” তিনি আরও দাবি করেন, “বিশ্বকাপের সময় হ্যান্ডশেকের বদলে আলিঙ্গন করতেন।

এছাড়া নারী দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি, কোচ ইমন, ম্যানেজার ফাইয়াজ, কর্মকর্তা বাবু এবং ক্রিকেটার পিংকি, নাহিদা আক্তার ও রিতুমনির বিরুদ্ধেও তিনি গোষ্ঠীভিত্তিক আচরণ, অন্যায় সুযোগ বণ্টন ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন।

এমন গুরুতর অভিযোগের পর বিসিবি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে। বোর্ডের এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,

 অভিযোগগুলো আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছি। এতজনের নাম আসায় এটি এখন বোর্ড পর্যায়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সভাপতি ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানো হয়েছে। নিশ্চয়ই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

তবে একইসঙ্গে বোর্ডের এক বিবৃতিতে এসব অভিযোগকে “ভিত্তিহীন, মনগড়া ও অসত্য” বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। বিসিবির ভাষ্য, “বর্তমান নারী দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এমন বিভ্রান্তিকর বক্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন বাংলাদেশ নারী দল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসনীয় সাফল্য ও ঐক্য প্রদর্শন করছে।

অভিযোগে নাম আসা নারী দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন,

এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমাদের দলের ভেতরে কেউ কারও প্রতি অশোভন আচরণ করেনি। নারী ক্রিকেট আজ যে জায়গায় পৌঁছেছে, এমন বিভ্রান্তিকর মন্তব্য আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে হেয় করছে।

জাহানারার বক্তব্যে নারী ক্রিকেটের ভেতরের অস্থিরতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নতুন করে সামনে এসেছে। এর আগেও নারী দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের মধ্যে মনোমালিন্যের খবর প্রকাশিত হয়েছিল, তবে এবার তা অনেক বেশি স্পষ্ট ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

অন্যদিকে, নারী দলের সাবেক কর্মকর্তাদের দাবি—এই অভিযোগগুলো অনেকটাই অতিরঞ্জিত ও ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে দেওয়া। তাদের ভাষায়, নারী ক্রিকেটের উন্নতির এই সময়ে এমন মন্তব্য পুরো টিম পরিবেশকে নষ্ট করছে।

সম্প্রতি শেষ হওয়া নারী বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল সাত ম্যাচে এক জয় নিয়ে অষ্টম দলের মধ্যে সপ্তম স্থানে টুর্নামেন্ট শেষ করেছে। দলের পারফরম্যান্স নিয়ে বিশ্লেষণ হওয়ার কথা থাকলেও এখন মূল আলোচনায় চলে এসেছে অভিযোগ–প্রতিঅভিযোগের ঝড়।

ক্রীড়া বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি নারী ক্রিকেটের মানসিক প্রস্তুতি ও সংগঠন কাঠামোর দুর্বলতা প্রকাশ করে। অভিযোগ সত্য হোক বা মিথ্যা—একটি স্বচ্ছ তদন্তই এখন একমাত্র সমাধান।

বিসিবি ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। অভিযোগ যাচাইয়ের পাশাপাশি নারী ক্রিকেটের ভেতরকার ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও নীতি পুনর্বিবেচনার কথাও ভাবছে বোর্ড।

ক্রীড়া অঙ্গনের অনেকে মনে করছেন, এই ঘটনা যদি যথাযথভাবে তদন্ত ও সমাধান না হয়, তাহলে নারী ক্রিকেটের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং খেলোয়াড়দের পারস্পরিক আস্থা দুটোই বড় আঘাত পাবে।